কুংফু কারাটের জনক বোধিধর্ম


বর্তমানে কুংফু কারাটের নাম উঠলে সবার আগেই আমরা চিন, জাপান বা কোরিয়া নাম নেই। বিশেষ করে কুংফু প্রসঙ্গে চিনের নাম আসবেই।কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা কুংফু ক্যারাটে হল, প্রাচীন ভারতীয় আত্মরক্ষার এক প্রায়োগিক বিদ্যার চৈনিক সংস্করণ। বৈদিকযুগ থেকেই আত্মরক্ষার এ প্রায়োগিক বিদ্যার ভারতবর্ষে অনুশীলন হচ্ছে। আজও দক্ষিণ ভারতের কেরালাতে আত্মরক্ষার এ বিদ্যা  'কালারিপাট্টু' নামে প্রচলিত। আত্মরক্ষার কালারিপাট্টুর  বিদ্যার স্রষ্টা হলেন বিবিধ অস্ত্রবিদ্যার গুরু ভগবান পরশুরাম। শাস্ত্রে আত্মরক্ষাকে মহাধর্ম বলা হয়েছে। যে কোন উপায়ে আগে নিজের দেহকে  রক্ষা করতে বলছে। 



দেশভঙ্গে,প্রবাসে বা ব্যাধিষু ব্যাসনেষ্বপি।

রক্ষেদেব স্বদেহাদি পশ্চার্দ্ধর্ম্মং সমাচরেৎ।।

যেন কেন চ ধর্ম্মেণ মৃদুনা দারুণেন চ।

উদ্ধরেদ্দীনমাত্মাং সমর্থো ধর্মমাচরেৎ।।

(পরাশর সংহিতা:৭ অধ্যায়,৪১-৪২)


"দেশভঙ্গে, প্রবাসে, বিপদের সময়, শরীর পীড়াক্রান্ত হলে, তখন যেকোন উপায়ে আগে নিজের দেহকে রক্ষা করতে হবে । এরপরে সুস্থ হয়ে সকল ধর্মাচরণ করবে। স্বয়ং বিপন্ন হলে, অল্প কিংবা কঠিন, যে কোন উপায়ে আগে নিজের দীনাত্মাকে উদ্ধার করবে, তৎপরে সমর্থ হয়ে ধর্মাচরণ করবে"


প্রাচীন ভারতীয় আত্মরক্ষার প্রায়োগিক বিদ্যার চৈনিক সংস্করণের জনক হলেন দক্ষিণ ভারতীয় এক মহান সন্ন্যাসী, যাঁর নাম বোধিধর্ম। বোধিধর্মের জন্ম সন নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। তবে তিনি যে প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বের এটা প্রায় নিশ্চিত। কারণ খ্রিস্টাব্দ তৃতীয় শতাব্দী থেকেই পল্লব সাম্রাজ্যের সূত্রপাত হয়। এ বৃহৎ সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল কাঞ্চীপুরম্। দক্ষিণ ভারতের এ কাঞ্চীপুরম্ নগরেই পল্লব মহারাজের তৃতীয় সন্তান হিসেবে জন্ম নেয় বোধিধর্ম । চিনের বিখ্যাত সাওলিন টেম্পলে আজও বোধিধর্ম‌কে ভগবান বুদ্ধদেবের অবতার হিসাবে পূজা করা হয়। অথচ আমরা ভারতবর্ষের অনেকে তাঁর নাম আজও  জানিনা। অবশ্য এর একটি কারণও আছে। কারণ আমরা হলাম  ইতিহাস বিস্মৃত একটি আত্মঘাতী সম্প্রদায়। বোধিধর্ম‌ পল্লব রাজমাতার আদেশে দক্ষিণ ভারত থেকে তিনবছর পরিভ্রমণ করে চিন দেশে গেলে চিনের এক রাজা তাকে প্রথমে আপ্যায়ন সমাদর করে পরবর্তীতে অহেতুক ভুল বোঝে। বোধিধর্ম এরপরে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে তাদের সাথে বসবাস করেন। তৎকালে চিনের যে অঞ্চলে বোধিধর্মা ছিলেন, সেই অঞ্চলে বর্তমান করোনা ভাইরাসের মত ভয়ংকর ছোয়াছে মহামারীর উৎপাত শুরু হয়। বোধিধর্ম তখন নিজহাতে আয়ুর্বেদীয় ওষুধ তৈরি করে মহামারীর হাত থেকে চৈনিকদের রক্ষা করেন।কাঞ্চীপুরমের পল্লব রাজবংশের রাজপুত্র হয়েও সন্ন্যাসির মত খুব সাধারণ জীবনযাত্রা নির্বা‌হ করতেন বোধিধর্ম। 


বোধিধর্ম‌ বিভিন্ন বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে চৈনিকদের আত্মরক্ষার সকল কৌশল শিখিয়ে দেন। তিনি ছিলেন একাধারে যোদ্ধা, চিকিৎসক, দার্শনিক, সন্ন্যাসী । তিনি ছিলেন সম্মোহন বিদ্যায় পারদর্শী। আমৃত্যু তিনি অসংখ্য দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময়ের ওষুধ বানিয়ে ছিলেন; অবশ্য যা পরবর্তীতে চিনদেশের মেধাসম্পত্তি হয়ে যায়। দক্ষিণ ভারতে বোধিধর্ম‌কে নিয়ে বহু প্রবাদ আজও প্রচলিত। সারাজীবন চিনের মানুষের জন্যে কাজ করে শেষ জীবনে বোধিধর্ম যখন নিজদেশে ভারতবর্ষে ফিরতে চান, তখন চৈনিকদের স্বভাবসূলভ বিশ্বাসঘাতকতায় তাঁর আর নিজদেশে ফেরা হয়নি। দেশে ফেরার পূর্বরাত্রিতে, সকল গ্রামবাসী তাঁকে সম্মান জানিয়ে একটি ভোজের আয়োজন করে। বোধিধর্ম সে ভোজের খাবার হাতে নিয়েই বুঝতে পারেন যে খাবারে বিষ মেশানো। তিনি বলেন, "সারাটি জীবন তোমাদের কল্যাণের জন্যে সমর্পণ করার পরেও তোমরা আমার খাবারে বিষ দিয়ে আমাকে হত্যা করতে কেন চাচ্ছ?" উত্তরে অকৃতজ্ঞ চৈনিকরা বলে, "আমরা আপনাকে চাই, জীবিত অথবা মৃত। আপনাকে আমরা আপনার স্বদেশে ফিরে যেতে দেব না"। চৈনিক গ্রামবাসীর উত্তর শুনে বিস্মিত মর্মাহত বোধিধর্ম বলেন, "আমি হাসিমুখেই এ অকৃতজ্ঞতার বিষ গ্রহণ করলাম"। এভাবেই  অকৃতজ্ঞ চিনারা প্রায় দুইহাজার বছর পূর্বে হত্যা করে কুংফু-কারাটের জনক বোধিধর্মকে।ভারববর্ষের সন্ন্যাসী বোধিধর্মার সাথে যা হয়েছে, ভারত সহ প্রত্যেকটি জাতির সাথে সেই একই অকৃতজ্ঞতা, বিশ্বাসঘাতকতা এ একবিংশ শতাব্দীতেও আজও  করে চলছে চিন। যার সাক্ষী প্রতিনিয়ত আমরা পৃথিবী জুড়ে দেখছি।


কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Post a Comment

0 Comments